১০ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ২৬শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ৩রা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি রাত ২:০৭ রবিবার হেমন্তকাল
বাংলাদেশের জোট রাজনীতির দীর্ঘদিনের চেনা সমীকরণ এক অদৃশ্য কালির আঁচড়ে বদলে যেতে বসেছে। পরিচয়ের স্বকীয়তা এবং জোটের ঐক্যের শক্তি—এই দুইয়ের মধ্যে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একটি প্রস্তাব। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রতিটি দলকে নিজ নিজ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এই একটিমাত্র বিধান দেশের রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্ক ও মেরুকরণের জন্ম দিয়েছে, যেখানে এক পক্ষ একে দেখছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হিসেবে, অন্য পক্ষ দেখছে বিরোধী শিবিরকে দুর্বল করার সূক্ষ্ম কৌশল হিসেবে।
এই সিদ্ধান্তের সবচেয়ে কড়া সমালোচক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন একটি পরিবর্তন আনার আগে অংশীজনদের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা করা হয়নি, যা একটি অগণতান্ত্রিক চর্চা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতার মতে, “এটি স্পষ্টতই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ঐক্যকে ব্যালট পেপারে খণ্ডিত করার একটি নীলনকশা। যখন আমরা একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন এই নিয়ম আমাদের সাংগঠনিক ঐক্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির একটি প্রচেষ্টা।” দলটি এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং দ্রুততম সময়ে তা বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়ার কথা ভাবছে।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক অঙ্গনের ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। বেশ কিছু দল, বিশেষ করে যারা বড় জোটের শরিক হিসেবে পরিচিত, তারা ইসির এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের মতে, জোটের ছাতার নিচে নির্বাচন করতে গিয়ে প্রায়শই ছোট দলগুলোর নিজস্ব পরিচিতি ও প্রতীক ভোটারদের কাছে পৌঁছায় না। বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করায় তাদের সাংগঠনিক শক্তিও সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। নতুন এই নিয়ম কার্যকর হলে প্রতিটি দল তাদের স্বতন্ত্র আদর্শ ও প্রতীক নিয়ে জনগণের সামনে দাঁড়াতে পারবে, যা আখেরে দলের নিজস্ব ভিত্তিকেই মজবুত করবে। এক দলের মহাসচিব বলেন, “এটি আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ। আমরা জোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি, কিন্তু আত্মবিসর্জন দিয়ে নয়।”
এই তুমুল বিতর্কের মাঝে নির্বাচন কমিশন নিজেদের অবস্থানে অনড়। সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ায় আপাতত এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন কমিশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তবে বিষয় হলো, এই নিয়মের উৎস। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সাম্প্রতিক সংলাপে প্রতীকের বিষয়টি উত্থাপিত না হলেও, অতীতে সরকার গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালার ধুলো ঝেড়েই ইসি এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।
শেষ পর্যন্ত এই বিধান কি জোটের রাজনীতিতে ছোট দলগুলোকে স্বাবলম্বী করবে, নাকি বিরোধী জোটের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে নির্বাচনী মাঠকে নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা—সেই প্রশ্নই এখন মুখ্য। এই একটিমাত্র নিয়ম আগামী দিনে দেশের নির্বাচনী মানচিত্র এবং জোটবদ্ধতার সংস্কৃতিকে কোন পথে চালিত করে, সেই উত্তর এখন সময়ের হাতেই তোলা রইল।
Analysis | Habibur Rahman








