.
আরও

দুর্নীতির অলিখিত সংবিধান: যেভাবে একটি অনৈতিকতা আমাদের ‘স্বাভাবিক’ জীবনে পরিণত হলো

Email :3

দুর্নীতির অলিখিত সংবিধান: যেভাবে একটি অনৈতিকতা আমাদের ‘স্বাভাবিক’ জীবনে পরিণত হলো

আমাদের সমাজে দুটি সংবিধান চালু আছে। একটি কাগজে-কলমে, যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। অন্যটি অলিখিত, যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। এই দ্বিতীয় সংবিধানটির নাম—দুর্নীতি। এটি এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়া কোনো অপরাধ নয়, বরং একটি ‘সার্ভিস চার্জ’; যেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আইনের চেয়ে শক্তিশালী এবং যেখানে সততা এক ধরনের বোকামি হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু কীভাবে এই অলিখিত সংবিধান আমাদের সমাজের শিরা-উপশিরায় এতটা গভীর ও ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠল?

এর উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের সেই ক্ষতবিক্ষত সময়ে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অরাজকতা এবং ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ কেবল একটি ভূখণ্ড বা অর্থনীতিকেই ধ্বংস করেনি, বরং আমাদের সামাজিক নৈতিকতার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন টিকে থাকার জন্য মানুষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং পারস্পরিক লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সেই সংকটময় সময়ে যা ছিল বেঁচে থাকার কৌশল, ধীরে ধীরে তাই পরিণত হলো আমাদের সামাজিক অভ্যাসে।

এই অভ্যাসই জন্ম দিয়েছে এক অদ্ভুত মনস্তত্ত্বের: “সবাই যখন করছে, তখন আমি একা সৎ থেকে কী হবে?” এই ‘যৌথ কর্মের ফাঁদ’ (Collective Action Trap) দুর্নীতিকে এক অপ্রতিরোধ্য চক্রে পরিণত করেছে। একজন সৎ কর্মকর্তা যখন দেখেন তার সহকর্মীরা অবৈধ পথে সম্পদ গড়ছে এবং পুরস্কৃত হচ্ছে, তখন তার নিজের সততা অর্থহীন মনে হতে শুরু করে। একজন সাধারণ নাগরিক যখন দেখেন ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না, তখন তিনিও এই ব্যবস্থাকে মেনে নিতে বাধ্য হন। এভাবেই দুর্নীতি ব্যক্তিগত বিচ্যুতি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং বিধ্বংসী। দুর্নীতি একটি অদৃশ্য করের মতো, যার সবচেয়ে ভারী বোঝা বহন করতে হয় সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষকে। এটি দেশের উন্নয়নকে শুধু বাধাগ্রস্তই করে না, বরং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক গভীর হতাশা ও অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। যখন দেশের ৭০ শতাংশ যুবক মনে করে দুর্নীতিই উন্নয়নের প্রধান কাঁটা, তখন বুঝতে হবে এই অলিখিত সংবিধান আমাদের ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এই চক্র ভাঙার পথটি সরল নয়। ডিজিটাল সেবা বা কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এর সমাধান নয়, যদি না ব্যবস্থার মূল থেকে পরিবর্তন আসে। এর জন্য প্রয়োজন এমন এক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যা দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকদের সুরক্ষা দেবে না এবং এমন এক সামাজিক জাগরণ, যা এই অলিখিত সংবিধানকে সম্মিলিতভাবে প্রত্যাখ্যান করবে। প্রশ্ন হলো, সেই নৈতিক সাহস এবং সম্মিলিত সদিচ্ছা কি আমাদের আছে?

Analysis | Habibur Rahman

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts