
একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে যখন নারী নেতৃত্বের জয়গান, তখন জাপানের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ তার দুই হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম একজন নারীকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে দেখলো। ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে সানায়ে তাকাইচির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়াকে সরল চোখে দেখলে মনে হবে, এটি সূর্যোদয়ের দেশে নারী ক্ষমতায়নের চূড়ান্ত বিজয়। কিন্তু পর্দার আড়ালের সত্যটি এর চেয়েও অনেক বেশি জটিল এবং সম্ভবত খানিকটা সাংঘর্ষিকও।
তাকাইচির এই আরোহণ কোনো মসৃণ পথে হয়নি। এটি ঘটেছে এক টালমাটাল রাজনৈতিক আবহে, যখন তার দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ধারাবাহিক কেলেঙ্কারির কালিমা মেখে জনসমর্থনের তলানিতে অবস্থান করছিল। এক দশকে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখা জাপান যে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে, তাকাইচির সংখ্যালঘু জোট সরকার তারই প্রমাণ। ক্ষমতা নিশ্চিত করতে তাকে অন্য দলের সঙ্গে দর-কষাকষি করে জোট গঠনের বাধ্যবাধকতার পথেই হাঁটতে হয়েছে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি উঠেছে তাকাইচির পরিচয় ঘিরে। তিনি কেবল জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং জাপানের রক্ষণশীল মহলের এক শক্তিশালী মুখ।
আর এখানেই তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত দ্বিধা। যে রক্ষণশীলতাকে জাপানের নারী প্রগতির পথে অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা হয়, সেই মতাদর্শের একজন পতাকাবাহীই এখন দেশের সর্বোচ্চ আসনে। জাপানের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে চলছে এক নীরব কিন্তু জোরালো কথোপকথন। একদল এই নির্বাচনকে প্রতীকী বিজয় হিসেবে দেখছে, যা ভবিষ্যতের জন্য নতুন দ্বার খুলে দেবে। অপর দল শঙ্কিত, কারণ তাদের মতে, এই নির্বাচন নারী প্রগতির নামে রক্ষণশীল এজেন্ডাকেই আরও পোক্ত করার একটি কৌশল হতে পারে। তাদের প্রশ্ন, যার রাজনৈতিক দর্শনই নারী-পুরুষের চিরাচরিত ভূমিকার উপর দাঁড়িয়ে, তার কাছ থেকে কি লিঙ্গ সমতা বা কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিয়ে যুগান্তকারী কোনো পদক্ষেপ আশা করা যায়?
সুতরাং, সানায়ে তাকাইচির প্রধানমন্ত্রিত্ব কেবল একটি রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি জাপানের জন্য একটি সামাজিক পরীক্ষাও বটে। এই ঐতিহাসিক অর্জন কি শেষ পর্যন্ত কেবল একটি प्रतीकी ঘটনা হয়েই থাকবে, নাকি সত্যিই জাপানি নারীদের জীবনে কাঠামোগত পরিবর্তনের সূচনা করবে? এর উত্তর নির্ভর করছে তাকাইচি কোন পরিচয়টিকে বেছে নেবেন তার উপর—ইতিহাসের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, নাকি তার রক্ষণশীল রাজনৈতিক আদর্শের বিশ্বস্ত রক্ষক।
সারা বিশ্ব এখন জাপানের দিকে তাকিয়ে, কারণ এই গল্পের শেষটা নির্ধারণ করে দেবে একটি জাতির ভবিষ্যতের গতিপথ। বিশ্ব দেখবে, তিনি কি ইতিহাসের গতিপথ বদলাবেন, নাকি কেবল ইতিহাসের একটি নতুন পাদটীকা হয়েই থেকে যাবেন।
Analysis | Habibur Rahman







