.
অর্থনীতি

খেলাপি ঋণের সুনামি পৌনে সাত লাখ কোটি টাকার দায় কাঁধে নিয়ে ডুবছে ব্যাংকিং খাত

Email :19

বাংলাদেশের অর্থনীতি এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এক অকল্পনীয় উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ, ব্যাংক থেকে দেওয়া প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে ৩৩ টাকাই এখন খেলাপির খাতায়।

বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে ব্যাংকিং খাতের জন্য এক “সুনামি” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, যা দেশের অর্থনীতিকে এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এক বছরে তিনগুণ বৃদ্ধি, শীর্ষে বাংলাদেশ

আশঙ্কার বিষয় হলো, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি, বরং এর বৃদ্ধি ঘটেছে অবিশ্বাস্য গতিতে। মাত্র এক বছর আগে, ২০২৪ সালের জুন মাসেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, মাত্র ১২ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হারে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন শীর্ষে অবস্থান করছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

এই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের সরাসরি প্রভাবে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। দেশের ২৪টি ব্যাংক প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে, যা তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানো এবং নতুন ঋণ বিতরণের সক্ষমতাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।

প্রভাবশালী খেলাপিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এই সংকটের পেছনে মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন ৩,৪৮৩ জন ইচ্ছাকৃত খেলাপি। উদ্বেগজনকভাবে, এদের একটি বড় অংশই রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (BFIU) তথ্য আরও জানাচ্ছে, বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপ, এবং নাসা গ্রুপের মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীর অনেক কর্তাব্যক্তি বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। তাদের অনেকেই বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ বা বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করে নিজেদের সুরক্ষিত রেখেছেন। ফলে দেশীয় আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

আদায়ের নামে ছাড়ের ছড়াছড়ি, নেই আস্থা

খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি কিছু নতুন নীতি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • পুনঃতফসিল নীতি (২০২৫): খেলাপিরা মাত্র ২% নগদ অর্থ জমা দিয়েই ১০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদে তাদের ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ পাচ্ছেন।
  • অবলোপন নীতি শিথিল: আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে বাদ দেওয়ার (অবলোপন) শর্ত তুলে নেওয়া হয়েছে, যা ব্যাংকগুলোকে তাদের ব্যালেন্স শিট কৃত্রিমভাবেดูดี দেখানোর সুযোগ করে দেবে।
  • প্রণোদনা: অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে সফল হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের ৫% নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নীতিগুলো বড় খেলাপিদের জন্য আরও একটি “বিশেষ ছাড়” ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের মতে, এই পদক্ষেপে কিছু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার ঋণ হয়তো আদায় হতে পারে, কিন্তু যারা হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে সম্পদ গড়েছেন, তাদের ফিরিয়ে আনা বা তাদের থেকে অর্থ আদায় করা প্রায় অসম্ভব। মূল সমস্যা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে নিহিত।

সমাধান কোন পথে?

বিশেষজ্ঞরা এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপের পরামর্শ দিচ্ছেন:
১. আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ: বিদেশে পালিয়ে থাকা বড় খেলাপিদের সম্পদ জব্দ করতে এবং তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোল ও আন্তর্জাতিক আদালতের সহায়তা নিতে হবে।
২. ডিজিটাল ট্র্যাকিং: স্বচ্ছ ক্রেডিট ইতিহাস এবং ডিজিটাল ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করে নতুন করে ইচ্ছাকৃত খেলাপি তৈরির পথ বন্ধ করতে হবে।
৩. স্বাধীন ব্যাংকিং ও বিচার ব্যবস্থা: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।

সার্বিকভাবে, বর্তমান আদায় নীতিগুলো একটি রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য সামান্য ব্যান্ডেজ মাত্র। যদি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বড় খেলাপিদের আইনের আওতায় আনা না যায়, তবে দেশের ব্যাংকিং খাত তথা পুরো অর্থনীতিকে এই দীর্ঘমেয়াদি সংকট থেকে উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব একটি লড়াই হবে।

Analysis | Habibur Rahman

  • বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৫
  • খেলাপি ঋণ আদায়ের নতুন নীতি
  • বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সর্বশেষ খবর
  • পলাতক ঋণ খেলাপিদের তালিকা
  • কেন খেলাপি ঋণ বাড়ে
  • খেলাপি ঋণের সমাধান কি
  • দক্ষিণ এশিয়ায় খেলাপি ঋণের হার
  • রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ খেলাপি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts