একটি অগ্নিকাণ্ড, বিলিয়ন ডলারের ক্ষত: শাহজালালের আগুন যেভাবে কাঁপিয়ে দিল দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড।

শুধু আগুনের লেলিহান শিখা নয়, ১৮ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজকে গ্রাস করেছিল দেশের অর্থনীতির এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। পেছনে রেখে গেছে শুধু ছাই নয়, বরং প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বা এক বিলিয়ন ডলারের এক বিরাট আর্থিক ক্ষত, যা দেশের প্রধান অর্থনৈতিক প্রবেশদ্বারের নিরাপত্তা নিয়ে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য নতুন প্রশ্নের।
দুপুর ২:১৫ মিনিটে যে আগুনের সূত্রপাত, তা নিভতে সময় লেগেছে দীর্ঘ সাত ঘণ্টা। এই সময়ে ঢাকার আকাশে কেবল কালো ধোঁয়ার দৈত্যাকার কুণ্ডলীই দেখা যায়নি, দেখা গেছে দেশের সাপ্লাই চেইনের অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিটের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর সদস্যরা যখন আগুনের বিরুদ্ধে এক সমন্বিত মহাযুদ্ধে লিপ্ত, তখন রানওয়েতে নেমে এসেছিল সুনসান নীরবতা। ১৩টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে বাধ্য হয়ে ঠিকানা বদলাতে হয়েছে, যার ফলে হাজারো যাত্রী পড়েন চরম অনিশ্চয়তায়।
তবে এই ঘটনার আসল আঘাতটা লেগেছে দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ডে। প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র উঠে আসছে, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। পুড়ে যাওয়া পণ্যের তালিকায় রয়েছে পোশাক শিল্পের জন্য আনা গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ও স্যাম্পল, অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন, জরুরি মেশিনারি এবং মূল্যবান রাসায়নিক। রপ্তানি পণ্যগুলো সুরক্ষিত থাকলেও আমদানি পণ্যের এই বিশাল ক্ষতি ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়েছে। পোশাক শিল্পের জন্য এটি কেবল কাঁচামালের ক্ষতি নয়, বরং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে এক বিশাল ধাক্কা। উৎপাদনে বিলম্ব এবং নতুন করে পণ্য আমদানির বিপুল খরচ এখন শিল্পমালিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
এই ধ্বংসযজ্ঞের উৎস কী? কুরিয়ার গোডাউনে থাকা কোনো রাসায়নিকের বিস্ফোরণ নাকি নিছকই দুর্ঘটনা? বাতাসে নাশকতার গুঞ্জন উড়লেও দায়িত্বশীল সূত্রগুলো এখনই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে নারাজ। কারণ অনুসন্ধানে এবং ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র নিরূপণে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টের দিকেই এখন তাকিয়ে আছে পুরো দেশ।
এই ঘটনা বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে সরাসরি প্রভাব ফেলবে না বলে কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করলেও, এটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। গত এক দশকে বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া একাধিক ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করে, সাবধানতার ঘণ্টা অনেক আগেই বেজেছিল।
এই অগ্নিকাণ্ডটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়, বরং দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর দুর্বলতা এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি কঠোর সতর্কবার্তা। এই ছাই থেকে বাংলাদেশ কী শিক্ষা নেয়, তার ওপরই নির্ভর করছে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ।
Analysis | Habibur Rahman







